উচ্চ রক্তচাপ (হাই ব্লাড প্রেসার) সম্পর্কিত তথ্য
ব্লাড প্রেসার বা রক্তচাপ হলো দেহের ভেতরে প্রবাহিত রক্তের চাপ। ধমনিতে রক্তচাপ বেশি থাকলে সেটিকে উচ্চ রক্তচাপ বা হাই ব্লাড প্রেসার বলা হয়। একজন সুস্থ মানুষের সাধারণ রক্তচাপ হয় ১২০/৮০ মিলিমিটার মার্কারি। তবে, যদি রক্তচাপ ১৪০/৯০ মিলিমিটার মার্কারি বা তার বেশি হয়, তবে তা উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
উচ্চ রক্তচাপের প্রভাব
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর ২০২৩ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, উচ্চ রক্তচাপ বিশ্বব্যাপী প্রতি তিনজনের মধ্যে একজনকে প্রভাবিত করে। ১৯৯০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ৬৫০ মিলিয়ন থেকে ১.৩ বিলিয়নে বৃদ্ধি পেয়েছে। উচ্চ রক্তচাপ সাধারণত দীর্ঘদিন কোনো উপসর্গ ছাড়াই চলতে পারে, তবে এটি হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক, চোখ এবং কিডনির ক্ষতি করতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপের কারণ
উচ্চ রক্তচাপের পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে, যেমন:
কার্ডিওভাসকুলার রোগ, কিডনি রোগ (যেমন গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস, পলিসিস্টিক রেনাল ডিজিজ), মস্তিষ্ক বা অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির টিউমার, ডায়াবেটিস, হাইপারথাইরয়েডিজম, অটোইমিউন রোগ (যেমন লুপাস, স্ক্লেরোডার্মা)।
পূর্বনির্ধারিত ঝুঁকি:
বংশগতির প্রভাব, মানসিক চাপ, স্থূলতা, শারীরিক পরিশ্রম না করা, ধূমপান, অপর্যাপ্ত ঘুম, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ ইত্যাদি।
বয়স: ৬৫ বছরের বেশি বয়সে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বেড়ে যায়।উচ্চ রক্তচাপের উপসর্গ
প্রাথমিক পর্যায়ে উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষ কোনো উপসর্গ অনুভব করেন না। তবে, খুব উচ্চ রক্তচাপ (১৮০/১২০ মিলিমিটার মার্কারি বা তার বেশি) হলে কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে, যেমন:
- গুরুতর মাথাব্যথা
- বুকের ব্যথা
- মাথা ঘোরা বা মাথাব্যথা
- শ্বাস নিতে অসুবিধা হওয়া
- বমি বা বমির অনুভূতি
- ঝাপসা দৃষ্টি
- উদ্বেগ, বিভ্রান্তি
- কানে শব্দ হওয়া, নাক দিয়ে রক্ত পড়া
- অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে যেসব পদক্ষেপ নিতে হবে
১. স্বাস্থ্যকর শারীরিক ওজন বজায় রাখুন: শরীরের ভরসূচক (BMI) ১৮.৫-২৪.৯ এর মধ্যে থাকতে হবে। ওজন বাড়লে তা কমানোর চেষ্টা করুন।
২. শারীরিক পরিশ্রম: প্রতিদিন অন্তত ৩০-৪৫ মিনিট হাঁটুন। ১৫০ মিনিট হাঁটলে তা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করবে।
- সোডিয়াম (লবণ) গ্রহণ কমান: অতিরিক্ত লবণ রক্তচাপ বাড়ায়, তাই প্রতিদিন ৫ গ্রাম বা তার কম লবণ খাওয়ার চেষ্টা করুন।
- পটাসিয়াম যুক্ত খাবার খাওয়ুন: পটাসিয়াম রক্তচাপ কমাতে সহায়ক, যেমন ফল, শাকসবজি, দুধ ও বাদাম।
- স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্রান্স ফ্যাট পরিহার করুন: স্যাচুরেটেড ফ্যাট (যেমন মাখন, ঘি, পনির) এবং ট্রান্স ফ্যাট (যেমন কেক, কুকিজ) রক্তচাপ বাড়ায়। পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট (যেমন তিসির তেল, মাছের তেল) গ্রহণ করুন।
- ড্যাশ ডায়েট (DASH Diet): এটি একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্য পরিকল্পনা যা উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। এতে গোটা শস্য, সবজি, ফল, মাছ, মুরগি, বাদাম, ডাল এবং কম চর্বিযুক্ত দুগ্ধজাত পণ্য অন্তর্ভুক্ত থাকে। এতে পটাসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ক্যালসিয়াম, ফাইবার ও প্রোটিনের পরিমাণ বেশি।
- মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করুন: মানসিক চাপ রক্তচাপ বাড়ায়, তাই স্বাস্থ্যকর উপায়ে চাপ কমানোর চেষ্টা করুন (যেমন মেডিটেশন বা ইয়োগা)।
- ঘুমের পরিমাণ বজায় রাখুন: প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা ঘুমানো উচিত।
- ধূমপান ও অ্যালকোহল পরিহার করুন: ধূমপান এবং অ্যালকোহল রক্তচাপ বাড়ায়, তাই এগুলো পরিহার করা উচিত।
- বিশুদ্ধ পানি পান করুন: পর্যাপ্ত পানি পান করতে হবে, যা শরীরকে সুস্থ রাখে।
চিকিৎসা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ
যদি কারও উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা থাকে, তবে তা নিয়ন্ত্রণে রাখতে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়তা করবে।
মায়ের দুধের গুরুত্ব
গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তি শিশু বয়সে মায়ের দুধ পান করেছেন, তাঁদের রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল স্বাভাবিক থাকে। সেই সাথে অতিরিক্ত ওজন, স্থূলতা এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কম থাকে।উচ্চ রক্তচাপ একটি গুরুতর সমস্যা, তবে এটি সচেতনতা এবং জীবনযাত্রায় পরিবর্তন এনে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। সুস্থ জীবনযাপন এবং নিয়মিত মেডিকেল চেকআপের মাধ্যমে উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমানো যেতে পারে।